Admission
পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র - স্বাভাবিক ও কৃত্রিম উপগ্রহ

সূচনা : 

আমরা জানি সূর্য ও তার চারদিকের গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কা, নীহারিকা ইত্যাদি নিয়ে যে জগৎ তার নাম সৌরজগৎ। সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকে সূর্য। আর গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চারদিক প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহগুলোকে কেন্দ্র করে উপগ্রহগুলো তাদের চারদিকে ঘুরছে। যেমন পৃথিবী একটি গ্রহ। এটি সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। চন্দ্র পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। চন্দ্র পৃথিবীর চারদিক প্রদক্ষিণ করছে।

স্বাভাবিক উপগ্রহ : 

যে সব বস্তু বা জ্যোতিষ্ক গ্রহের চারদিকে ঘোরে, তাদেরকে উপগ্রহ বলে। যে সব উপগ্রহ প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট তাদেরকে স্বাভাবিক উপগ্রহ বলে। যেমন চন্দ্র প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অতএব চন্দ্র বা চাঁদ পৃথিবীর একটি স্বাভাবিক উপগ্রহ। তেমনি অন্যান্য গ্রহগুলোর ও স্বাভাবিক উপগ্রহ রয়েছে।

কৃত্রিম উপগ্রহ : 

আমরা জানি সৌরজগৎ নামে একটি জগৎ রয়েছে যার কেন্দ্রে থাকে সূর্য। সূর্য হতে ছিটকে আসা কতকগুলো জ্যোতিষ্ক সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এদের নাম গ্রহ (planet)। পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। পুনঃ, গ্রহ হতে ছিটকে আসা কতকগুলো জ্যোতিষ্ক গ্রহগুলোকে প্রদক্ষিণ করছে। এদের নাম উপগ্রহ (satellite)। চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ যা প্রায় ৩০ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের মনে কৌতূহল জাগছে কি করে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এই প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন অভিকর্ষের দরুন চাঁদের উপর পৃথিবীর কেন্দ্রমুখী বল এর কারণ। এই কেন্দ্রমুখী বল যদি না থাকত, তাহলে চাঁদ মহাশূন্যে মিলিয়ে যেত। পৃথিবীর চারদিকে চাদের প্রদক্ষিণের দরুন সৃষ্ট কেন্দ্রবিমুখী বল পৃথিবী কর্তৃক প্রযুক্ত কেন্দ্রমুখী বলের সমান ও বিপরীত হওয়ায় চাঁদ সোজা না গিয়ে পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষ মহাশূন্যে পাড়ি দেয়ার জন্যে যে উপগ্রহ তৈরি করেছে, তার নাম কৃত্রিম উপগ্রহ।

1957 সালের 4th অক্টোবর রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম মহাশূন্যে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠান। এর নাম স্পুটনিক-1। সে বছরেই আরো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠান হয়। এর নাম স্পুটনিক-2। এই সময় আমেরিকার বিজ্ঞানীরা পেছনে ছিলেন না। তাঁরাও 1958 সালে মহাশূন্যে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেন। এর নাম এক্সপ্লোরার-1। এমনিভাবে মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে পৃথিবী তথা সৌরজগতের নানা রকম রহস্য উদঘাটনের কাজ চলছে। রাশিয়ার বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইউরি গ্যাগারিন ভস্টক-1 কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সর্বপ্রথম মহাশূন্যে বিচরণ করেন।

পরীক্ষার সাহায্য দেখা গেছে যে কোন একটি বস্তুকে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 930 km উপরে তুলে 8:05 kms-1 হতে 11*1 kms-1 বেগে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করলে তা পৃথিবীর একটি কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে চাঁদের মত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে। কিন্তু কোন বস্তুকে এত উপরে তুলে এত বেশি বেগ দেয়া সম্ভব নয়। কারণ বায়ুস্তরের সাথে এর ঘর্ষণে এত অধিক তাপ উৎপন্ন হবে যে কৃত্রিম উপগ্রহটি পুড়ে ভস্মীভূত হবে। তাই বায়ুতে এত বেশি বেগ না দিয়ে বায়ুস্তর অতিক্রম করার পর কৃত্রিম উপগ্রহে এত বেশি বেগ প্রদান করা হয় এবং তা প্রদান করা হয় একটি রকেটের সাহায্যে তিনটি ধাপে। কৃত্রিম উপগ্রহটি বসানো হয় রকেটের নাকের ডগায় এবং জ্বালানি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসানো হয় রকেটের ভেতরে। ধাপগুলো নিম্নরূপ :

চিত্র :৭.১৯

 

সবচেয়ে নিচু স্তুরের রকেটটি সর্বপ্রথমে কাজ শুরু করে। এটি উপগ্রহ ও অপর দুটি স্তরের রকেটসহ খানিকটা খাড়া উপরে উঠে আস্তে আস্তে বাঁক নিতে থাকে। এই ধাপ প্রয়োজনীয় বেগের অংশ যোগানের পর খসে পড়ে। এই সময় দ্বিতীয় ধাপ কাজ শুরু করে এবং এই ধাপটি উপগ্রহটির বেগের প্রায় অংশ যোগানোর পর খসে পড়ে। তার পর শুরু হয় তৃতীয় ধাপের কাজ। এই ধাপটি উপগ্রহটিতে প্রয়োজনীয় বেগ প্রদান করে নিজে খসে পড়ে। উপগ্রহটি তখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে।

৭:২৪ বৃত্তাকার পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ কালে কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষীয় বেগ, আবর্তন কাল এবং উচ্চতার রাশিমালা 

Expression for orbital velocity, time period and height of an artificial satellite rotating around the earth in a circular path

 

(ক) বেগ ঃ 

মনে করি m ভরের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে h উচ্চতায় অবস্থান করে v বেগে বৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে। এখানে উপগ্রহটির উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল = উপগ্রহটির ঘূর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রমূখী বল।

 মনে করি পৃথিবীর ভর M এবং এর ব্যাসার্ধ R।

উপগ্রহটির উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল F=GMm(R+h)2

এটি পৃথিবীর কেন্দ্রাভিমুখী ক্রিয়া করছে। পুনঃ, উপগ্রহটির ঘূর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্ৰমুখী বল

F=mv2(R+h)

গতির সাম্যাবস্থা হতে পাই F=F'

   mv2(R+h)=GMm(R+h)2

বা, v2=GM(R+h)

:- v=GM(R+h)

চিত্র : ৭.২০

 

এটিই হল h উচ্চতায় উপগ্রহটির প্রদক্ষিণ বেগ ।

উল্লেখ্য কক্ষপথের ব্যাসার্ধ কম হলে বেগ কম হবে। শুধু তাই নয় সমীকরণে m না থাকায় উপগ্রহটির বেগ এর ভরের উপর নির্ভর করে না।

(খ) আবর্তনকাল বা পর্যায়কাল :

মনে করি কৃত্রিম উপগ্রহটির আবর্তন বা পর্যায়কাল = T, যদি উপগ্রহটির কৌণিক বেগ ω হয়, তবে 

v=ω× বৃত্তাকার পথের ব্যাসার্ধ

বা, v=ω(R+h)

বা,v=2πT(R+h)

বা,T=2πv(R+h)

উক্ত সমীকরণে v এর মান বসিয়ে পাই

T=2π(R+h)GM(R+h) 

বা, T=2π(R+h)3GM

এটিই হল কৃত্রিম উপগ্রহের আবর্তন কালের রাশিমালা।

 

(গ) কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা :

মনে করি পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতা = h সমীকরণ (40)-এর উভয় পার্শ্বকে বর্গ করে পাই

T2=4π2(R+h)3GM 

বা, R+h=GMT24π213

h=GMT24π213-R

 

এটিই হল কৃত্রিম উপগ্রহের উচ্চতার রাশিমালা এবং আবর্তনকান ও উচ্চতার মধ্যে সম্পর্ক।

 

৭:২৫, ভূ-স্থির উপগ্রহ

Geostationary satellite

আমরা জানি পৃথিবী 24 ঘণ্টায় তার অক্ষের চারদিকে একবার ঘুরে আসে। এর নাম আহ্নিক গতি যার ফলে দিবা-রাত্র হয়। কোন কৃত্রিম গ্রহের আবর্তন কাল এবং নিজ অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর আবর্তন কাল সমান হলে পৃথিবী পৃষ্ঠের একজন পর্যবেক্ষকের কাছে একে সব সময়ই স্থিতিশীল মনে হবে। পৃথিবীর যে স্থানের খাড়া উপর থেকে একে বৃত্তাকার কক্ষপথে স্থাপন করা হয় এটি পৃথিবীর ঐ স্থানের উপরই সব সময় স্থিতিশীল আছে বলে মনে হবে। এর নামই ভূ-স্থির উপগ্রহ এবং যে কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থিতিশীল থাকে তাকে পার্কিং (parking) কক্ষপথ বলে।

সংজ্ঞা : কোন কৃত্রিম উপগ্রহের আবর্তনকাল নিজ অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর আবর্তনকালের সমান হলে পৃথিবী সাপেক্ষে এটি স্থির থাকবে। এই ধরনের উপগ্রহকে ভূ-স্থির উপগ্রহ বলে। ভূ-স্থির উপগ্রহের কক্ষপথকে পার্কিং কক্ষপথ বলে।

মনে করি পৃথিবীর কেন্দ্রের সাথে এককেন্দ্রিক ভাবে নিরক্ষতলে (In the plane of equator) m ভরের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। উপগ্রহের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ এবং কক্ষপথে উপগ্রহের গতিবেগ এর উপর কেন্দ্রমুখী বা কেন্দ্রবিমুখী বল F=mv2r  (42)

পুনঃ, পৃথিবীর ভর M হলে মহাকর্ষীয় বল

F = F'

mv2r=GMmr2

বা, v2=GMr

কিন্তু অভিকর্ষীয় ত্বরণ

g=GMR2,=GM=gR2 

বা, v2=gR2r 

v=Rgr

যদি কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ বরাবর আবর্তন কাল T হয়, তবে

T=2πrv=2πrgrR=2πr3/2Rg

 এখন কৃত্রিম উপগ্রহের আবর্তন কাল এবং পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারদিকের আবর্তন কাল সমান হলে পৃথিবী থেকে উপগ্রহটিকে একই স্থানে স্থির দেখা যায়। এর নাম ভূ-স্থির উপগ্রহ এবং ঐ কক্ষপথের নাম পার্কিং কক্ষপথ । উল্লেখ্য, পার্কিং কক্ষপথে রিলে উপগ্রহ স্থাপন করে পৃথিবীর এক স্থানের সংবাদ, খেলাধূলা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি পৃথিবীর অন্য স্থানে ধারাবাহিকভাবে দেখানো যায়।

৭.২৬ কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার

Uses of artificial satellite

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে কৃত্রিম উপগ্রহের বহুল ব্যবহার রয়েছে। ব্যবহারগুলো নিচে উল্লেখ করা হল ঃ

(১) পৃথিবীর আকার ও আকৃতি সম্পর্কিত ভূ-জরিপ করা যায়।

(২) এর সাহায্যে ভূ-পৃষ্ঠের এলাকা সম্পর্কে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তথ্য প্রদান করা যায়।

(৩) উচ্চ বায়ুমণ্ডলের চাপ, তাপমাত্রা বা গঠন নির্ণয় করা যায়।

(৪) ঊর্ধ্বাকাশের আয়নমণ্ডল, কসমিক বিকিরণ, চার্জিত কণিকার ভ্যান আসেল বেষ্টনী, সৌর বিকিরণের প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

(৫) আবহাওয়া সম্পর্কীয় নিরীক্ষণ ও পূর্বাভাস পাওয়া যায় । 

(৬) বহির্বিশ্বে রনজেন রশ্মি, গামারশ্মি ইত্যাদির উৎস সংক্রান্ত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যান্য গবেষণা চালানো যায়।

(৭) প্রতিরক্ষামূলক পাহারা ও বিভিন্ন সামরিক ব্যবস্থায় এটি ব্যবহৃত হয়। 

(৮) আন্তমহাদেশীয় যোগাযোগে এটি ব্যবহার করা হয়।

(৯) পৃথিবীর যে-কোন দেশে অনুষ্ঠিত খেলাধূলা বা যে-কোন অনুষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখানো হয়।

(১০) কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা নির্ণয় করা যায়।

মহাশূন্যচারীর ওজনহীনতা : 

আমরা জানি, ওজন, W = mg। অর্থাৎ, ভর x অভিকর্ষ ত্বরণের গুণফল হল ওজন। বস্তুর ভর নির্দিষ্ট। মানুষের ভরও নির্দিষ্ট। কিন্তু g-এর মান তারতম্য হলে ওজন কম-বেশি হয়।

মহাশূন্যচারীরা খেয়াযানে পৃথিবী থেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করে। এই বৃত্তাকার গতির জন্য পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ঐ উচ্চতায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মানের সমান মানের একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয়। ফলে এই মহাশূন্য যানের' দেওয়াল বা পাটাতনের সাপেক্ষে মহাশূন্যচারীর ত্বরণ (g - g) = 0 হয়। তাই মহাশূন্যচারীর

ওজন W = m x 0 = 0।

Content added || updated By